১৮৭৪-৭৫ খ্রিস্টাব্দে সুন্দরবন বিভাগ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সুন্দরবনে সংরক্ষিত বন ব্যবস্থাপনার গোড়াপত্তন হয়। ১৮৬৫ সালের বন আইনের ২ নং ধারা অনুযায়ী ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৮৭৫ তারিখে বর্তমান খুলনা এবং বাগেরহাট জেলাধীন সুন্দরবনের বনাঞ্চলকে সংরক্ষিত ঘোষণা করা হয়। ১ আগস্ট ১৮৭৬ তারিখে বর্তমান সাতক্ষীরা জেলাধীন সুন্দরবনের বনাঞ্চলকে সংরক্ষিত ঘোষণা করা হয়। অতঃপর ১৮৭৮ সালের বন আইনের ৩৪ নং ধারা মোতাবেক পূর্বে সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষিত খুলনা, বাগেরহাট এবং সাতক্ষীরা জেলাধীন সুন্দরবনের বনাঞ্চলের সীমানা ২৩ জানুয়ারি ১৮৭৯ তারিখে পুনঃনির্ধারণ পূর্বক গেজেট প্রকাশিত হয়। সর্বশেষ ১৯১৫ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি তারিখে গেজেটের মাধ্যমে সুন্দরবনের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের সীমানা পুনঃনির্ধারণ করা হয়। ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে পূর্বে সুন্দরবনসহ সমগ্র উপকূলীয় এলাকার বনাঞ্চল ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ‘প্লান্টেশন সার্কেল’ এর উপর অর্পিত ছিল। ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে প্লান্টেশন সার্কেল বিভক্ত হয়ে যায় এবং সুন্দরবনের সংরক্ষিত বনাঞ্চল ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নবপ্রতিষ্ঠিত ‘খুলনা সার্কেল’ এর উপর ন্যস্ত করা হয়। তৎকালে সমগ্র সুন্দরবনের সংরক্ষিত বনাঞ্চল ‘সুন্দরবন বিভাগ’ এর নিয়ন্ত্রণে ছিল। ২০০১ খ্রিস্টাব্দে তা বিভক্ত করে সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগ ও সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হয়। সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের সদর দপ্তর খুলনায় এবং সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের সদর দপ্তর বাগেরহাটে অবস্থিত। বন সংরক্ষকের দপ্তর, খুলনা সার্কেল উক্ত বন বিভাগ দুইটির প্রশাসনিক কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে। সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের আওতায় খুলনা ও সাতক্ষীরা নামে ২ টি রেঞ্জ, ৯ টি স্টেশন এবং ২৮ টি টহল ফাঁড়ি রয়েছে।
প্রায় ১০,০০০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের পৃথিবীর বৃহত্তম নিরবিচ্ছিন্ন জোয়ারধৌত ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলা এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলায় অবস্থিত। ব্রিটিশ ভারত বিভাগের পর বনের দুই-তৃতীয়াংশ পড়েছে বাংলাদেশে, বাকিটা ভারতে। সমগ্র সুন্দরবনের প্রায় ৬,০১৭ বর্গকিলোমিটার বাংলাদেশে স্থিত, যার ৬৯% স্থলভাগ ও ৩১% জলভাগ। সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের আওতাধীন সুন্দরবনের মোট আয়তন ৩৫৭৩.২৮ বর্গ কিলোমিটার এবং তন্মধ্যে খুলনা জেলাস্থ সুন্দরবনের আয়তন ২০৭২.২৪ বর্গ কিলোমিটার। বাকিটা সাতক্ষীরা জেলাধীন।
সুন্দরবনকে বিশেষভাবে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছে উজানের জলপ্রবাহ, লবণাক্ত সামুদ্রিক স্রোতধারা এবং কাদা চর। দ্বীপমালা সুন্দরবনের নামকরণ নিয়ে রয়েছে নানান মত। অনেকে মনে করেন, নামটির আক্ষরিক অর্থেই নিহিত রয়েছে সারমর্ম। সুন্দরবন অর্থ সুন্দর জঙ্গল বা সুন্দর বনভূমি। সুন্দরবন নামের সম্ভাব্য আরেকটি উৎস মনে করা হয় সমুদ্রকে। সমুদ্রের তীরে বনের অবস্থান বলে ‘সমুদ্র বন' থেকে কালক্রমে এর নাম হয়েছে সুন্দরবন- এমনটি ধারণা করেন অনেকে। তবে অন্য এক জনশ্রুতিও আছে সুন্দরী গাছের পক্ষে। সাধারণভাবে গৃহীত ব্যাখ্যাটি হলো এখানকার প্রধান উদ্ভিদ সুন্দরী বৃক্ষের নাম থেকেই এ বনভূমির নামকরণ হয়েছে। জোয়ারভাটার কারণে এই বনভুমিতে জলাবদ্ধতা ও লবণাক্ততার প্রভাব সুস্পষ্ট। আর এ বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে এখানকার জীববৈচিত্র্যও অনন্য। নানা ধরনের গাছপালার চমৎকার সমারোহ ও বিন্যাস এবং বন্যপ্রাণীর অনন্য সমাবেশ এ বনভূমিকে চিহ্নিত করেছে এক অপরূপ প্রাকৃতিক নিদর্শন হিসেবে। অধিকাংশ উদ্ভিদ চিরসবুজ হওয়ার কারণে এদের সবার শারীরবৃত্তিক ও গঠনগত অভিযোজন কমবেশি একই রকম। অধিকাংশ বৃক্ষের আছে ঊর্ধ্বমুখী শ্বাসমূল, যার সাহায্যে এরা শ্বসনের জন্য বাতাস থেকে সরাসরি অক্সিজেন গ্রহণ করতে পারে। এ বনের প্রধান বৃক্ষ প্রজাতি সুন্দরী এবং গেওয়া । এছাড়া পশুর, ধুন্দল, গরান, বাইন, কাঁকড়া, কেওড়া ইত্যাদি গাছও প্রাকৃতিক ভাবে জন্মে। ১৯০৩ সালে মিস্টার ডেভিড প্রেইন সুন্দরবন ও সংলগ্ন এলাকার গাছপালার উপর লিখিত তাঁর গ্রন্থে ৩৩৪টি উদ্ভিদ প্রজাতি লিপিবদ্ধ করেছেন। ১৬৫ প্রজাতির শৈবাল ও ১৩ প্রজাতির অর্কিডও পাওয়া যায় সুন্দরবনে। আজ পর্যন্ত জানা প্রায় ৫০টির অধিক প্রকৃত ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ প্রজাতির মধ্যে কেবল সুন্দরবনেই আছে ৩৫টি প্রজাতি। অধিকাংশ ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ চিরসবুজ, খাটো গুল্মজাতীয় অথবা লম্বা বৃক্ষজাতীয়। সুন্দরবন নানা ধরণের প্রাণীবৈচিত্র্যে অনন্য। রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ আবাসস্থল হলো সুন্দরবন। সুন্দরবনে প্রায় ২৮৯ প্রজাতির স্থলজ প্রাণী বাস করে। এছাড়া আছে প্রায় ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ, ৮ প্রজাতির উভচর এবং বিভিন্ন প্রজাতির মাছসহ ২১৯ প্রজাতির জলজ প্রাণী। রয়েল বেঙ্গল টাইগার ছাড়া সুন্দরবনের উল্লেখযোগ্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে রয়েছে চিত্রা হরিণ, মায়া হরিণ, রেসাস বানর, বন বিড়াল, সজারু, উদ বিড়াল এবং বন্য শূকর। প্রায় ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপের মধ্যে সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় সদস্য মোহনার কুমির; এদের সংখ্যা প্রায় ২০০। সাপের মধ্যে রাজগোখরা, অজগর, কেউটে এবং কয়েক প্রজাতির সামুদ্রিক সাপ উল্লেখযোগ্য। অমেরুদন্ডী প্রাণীর মধ্যে কতিপয় মোলাস্কা এবং ক্রাসটেসিয়ান গুরুত্বপূর্ণ মৎস্যসম্পদ হিসেবে বিবেচিত। প্রজাতিগুলির মধ্যে তালিকাবদ্ধ হয়েছে প্রায় ২৪ প্রজাতির চিংড়ি, ১৪ প্রজাতির কাঁকড়া, কয়েক প্রজাতির শামুক এবং ঝিনুক। সুন্দরবনে বসবাসকারী ৩২০ প্রজাতির পাখির অধিকাংশই স্থানীয় বা আবাসিক। প্রায় ৫০ প্রজাতির পাখি পরিযায়ী এবং এদের অধিকাংশই হাঁসজাতীয়। বক, সারস, হাড়গিলা, কাদা-খোঁচা, লেনজা ও হট্টিটিসহ অসংখ্য উপকূলীয় পাখি এখানকার নদীনালার কিনারায় বিচরণ করে। সমুদ্র এবং বড় বড় নদীর উপকূলভাগে দেখা যায় বহু প্রজাতির গাংচিল, জলকবুতর, টার্ন ইত্যাদি। চিল, ঈগল, শকুন ইত্যাদিরও দেখা পাওয়া যায় সুন্দরবনে। এ বনে মাছরাঙার দেখা মেলে প্রতিনিয়তই। এছাড়া, কাঠঠোকরা, ভগীরথ, পেঁচা, মধুপায়ী, বুলবুল, শালিক, ফিঙে, বাবুই, ঘুঘু, বেনে, হাঁড়িচাঁচা, ফুলঝুরি, মুনিয়া, টুনটুনি ও দোয়েলসহ রয়েছে নানা ধরনের ছোট ছোট গায়ক পাখি। সুন্দরবনের কীটপতঙ্গের বৈচিত্র্যও সীমাহীন। এখানকার অর্থনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতি হলো মৌমাছি । স্থানীয়ভাবে পরিচিত মৌয়ালদের পেশা মধু সংগ্রহ করা। তারা বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে বন থেকে মধু সংগ্রহ করে। সর্বশেষ জরিপ মোতাবেক সুন্দরবনে ১১৪ টি বাঘ, ১,০০,০০০ থেকে ১,৫০,০০০ চিত্রা হরিণ, ২০,০০০ বানর এবং ২০,০০০ থেকে ২৫,০০০ বন্য শুকর রয়েছে।
Planning and Implementation: Cabinet Division, A2I, BCC, DoICT and BASIS