Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

শিরোনাম
সুন্দরবনে স্মার্ট টহল
ডাউনলোড

সুন্দরবনে বন ও বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন এবং বন্যপ্রাণী পর্যবেক্ষণে স্মার্ট টহল

 

মোঃ বশিরুল-আল-মামুন

উপ-বন সংরক্ষক (চলতি দায়িত্ব)

খুলনা অঞ্চল, খুলনা। (০৪ মে ২০১৭)

 

শুরুর কথাঃ

 

আজ থেকে শত বছর পূর্বের এমন একটি সময়ের কথা চিন্তা করুন যখন কয়েকজন বন প্রহরী এবং নৌকা চালক বৈঠা বেয়ে নৌকায় চেপে সুন্দরবনে টহল করছেন। তখনকার দিনে টহল পরিমাপ পদ্ধতি, তথ্য সংরক্ষণ পদ্ধতি, আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে দক্ষতা, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা প্রভৃতি ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা ছিল। ইদানিং সুন্দরবনে যে পদ্ধতিতে টহল পরিচালিত হচ্ছে তাতে উক্ত সীমাবদ্ধতাসমূহ প্রায় মূলোৎপাটিত হয়েছে। ৮ জনের একটি টহল দল কম্পিউটার, ইন্টারনেট সংযোগ, বৈদ্যুতিক জেনারেটর, ১২-১৪ দিনের খাবার-ঔষধ, দ্রুতগামী জলযান সহ অবস্থান উপযোগী জলযানে অবস্থান করে হাতে লগ বই ও জিপিএস রিসিভার নিয়ে, গলায় বাইনোকুলার ঝুলিয়ে, বুকে গো-প্রো ক্যামেরা বেঁধে, গায়ে বুলেট-প্রুফ জ্যাকেট জড়িয়ে নিরপত্তার বিষয় সর্বাগ্রে বিবেচনা করে সুন্দরবনের জলে-স্থলে টহল করছে। দিনের টহল শেষে নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ টহলের এলাকা, অতিক্রান্ত দূরত্ব, পর্যবেক্ষণকৃত বন্যপ্রাণী ও এদের প্রতি হুমকি সমূহ, উদঘাটিত অপরাধ, জব্দকৃত ও আটককৃত মালামাল, গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির বিবরণ প্রভৃতি সম্পর্কে জানতে পারছেন। সাথে সাথে পরবর্তী দিনে টহল পরিচালনার জন্য দিক-নির্দেশনাও দিতে পারছেন। নির্দিষ্ট মেয়াদের একটি টহল শেষে বিবিধ তথ্য সমৃদ্ধ প্রতিবেদনও প্রস্তুত করা সম্ভবপর হচ্ছে। বন্যপ্রাণী ও এদের আবাসস্থল, অপরাধ ও অপরাধী, বন্যপ্রাণী শিকার, বন্যপ্রাণীর পর্যাপ্ততা, বনজসম্পদ আহরণের হটস্পট প্রভৃতি বিষয়ে ডাটাবেজও তৈরি করা সম্ভবপর হচ্ছে। আগামী দিনে লগ বইয়েরও প্রয়োজন পড়বে না। লগ বই ও জিপিএস রিসিভারের স্থান দখল করেছে সাইবার ট্র্যাকার। সাইবার ট্র্যাকার একটি মোবাইল এপ্লিকেশন যা জিপিএস সুবিধাসম্পন্ন যে কোন স্মার্ট মোবাইল ফোনে ইন্সটল করা যায়। অর্থাৎ, আগামী দিনে একটি স্মার্ট মোবাইল ফোনের সাহায্যেই পরিচালিত হবে স্মার্ট টহল কার্যক্রম। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন পূরণের পথে বন অধিদপ্তরের অর্জনকে সমৃদ্ধ করেছে এক নতুন টহল পদ্ধতি যা স্মার্ট টহল (SMART Patrolling) নামে পরিচিতি পেয়েছে।

 

স্মার্ট টহলঃ

 

Spatial Monitoring And Reporting Tool (SMART) ভিত্তিক পরিচালিত টহল পদ্ধতিকে স্মার্ট পেট্রল বা স্মার্ট টহল বলা হয়। SMART অবস্তুগত অর্থ নির্দেশ করে, যার দ্বারা সফটওয়্যার, প্রশিক্ষণ উপকরণ এবং টহল পরিচালনার আদর্শ কার্যপ্রণালীর সমাহারকেই বুঝানো হয়। প্রেক্ষিত পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে শিকার এবং পাচার প্রতিরোধের জন্য নিয়োজিতদের দক্ষতা ও প্রেষণার ঘাটতি এবং প্রযুক্তিগত অনগ্রসরতাই বিশ্বব্যাপী বিলুপ্তপ্রায় এবং বিপন্ন বন্যপ্রাণী শিকার এবং পাচারের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারন। বন্যপ্রাণী ও তাদের প্রতি হুমকিসমূহ পর্যবেক্ষণ, বন্যপ্রাণী বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে শিক্ষা সম্প্রসারণ এবং আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যাবস্থাপকগণকে সহযোগীতা করার নিমিত্তে জুওলজিকাল সোসাইটি অব লন্ডন এবং বিশ্বের কয়েকটি শীর্ষস্থানীয় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ সংস্থা কর্তৃক SMART উদ্ভাবন করা হয়েছে। স্মার্ট টহল পরিচালনা শুরুর পর থেকেই বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপকগণের দক্ষতা ও প্রেষণার বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি স্মার্ট টহল প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার ক্ষেত্রে এক অনন্য মাত্রা যুক্ত করেছে। বিশ্বের প্রায় ৩১ টি দেশের ১৪০ টি রক্ষিত এলাকায় স্মার্ট টহল পরিচালিত হচ্ছে। শুধু বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া এবং বেলিজে জলজ পরিবেশে স্মার্ট টহল কার্যক্রম চলমান আছে। শীঘ্রই ফিলিপাইনেও জলজ পরিবেশে স্মার্ট টহল কার্যক্রম শুরু হবে।  

 

এক নজরে সুন্দরবন ও এর জীববৈচিত্র্যঃ

 

১৮৭৪-৭৫ খ্রিস্টাব্দে সুন্দরবন বিভাগ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সুন্দরবনে সংরক্ষিত বন ব্যবস্থাপনার গোড়াপত্তন হয়। ১৮৬৫ সালের বন আইনের ২ নং ধারা অনুযায়ী ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৮৭৫ তারিখে বর্তমান খুলনা এবং বাগেরহাট জেলাধীন সুন্দরবনের বনাঞ্চলকে সংরক্ষিত ঘোষণা করা হয়। ১ আগস্ট ১৮৭৬ তারিখে বর্তমান সাতক্ষীরা জেলাধীন সুন্দরবনের বনাঞ্চলকে সংরক্ষিত ঘোষণা করা হয়। অতঃপর ১৮৭৮ সালের বন আইনের ৩৪ নং ধারা মোতাবেক পূর্বে সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষিত খুলনা, বাগেরহাট এবং সাতক্ষীরা জেলাধীন সুন্দরবনের বনাঞ্চলের সীমানা ২৩ জানুয়ারি ১৮৭৯ তারিখে পুনঃনির্ধারণ পূর্বক গেজেট প্রকাশিত হয়। সর্বশেষ ১৯১৫ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি তারিখে গেজেটের মাধ্যমে সুন্দরবনের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের সীমানা পুনঃনির্ধারণ করা হয়।

­

প্রায় ১০,০০০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের পৃথিবীর বৃহত্তম নিরবিচ্ছিন্ন জোয়ারধৌত ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলা এবং ভারতের পশ্চিম বঙ্গ রাজ্যের চব্বিশ পরগণা জেলায় অবস্থিত। সমগ্র সুন্দরবনের প্রায় ৬,০১৭ বর্গকিলোমিটার বাংলাদেশে স্থিত। সুন্দরবন ম্যানগ্রোভ বনভূমির মৃত্তিকা ও বাস্তুসংস্থান অনন্য এবং এ বনভূমিতে জোয়ারভাটার কারণে জলাবদ্ধতা ও লবণাক্ততার প্রভাব সুস্পষ্ট।  এ বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে এখানকার জীববৈচিত্র্যও অনন্য। নানা ধরনের গাছপালার চমৎকার সমারোহ ও বিন্যাস এবং বন্যপ্রাণীর অনন্য সমাবেশ এ বনভূমিকে চিহ্নিত করেছে এক অপরূপ প্রাকৃতিক নিদর্শন হিসেবে। জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ বিধায় ১৯৯২ সালে সুন্দরবন ৫৬০তম রামসার সাইট হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। ইউনেস্কো ১৯৯৭ সালে সুন্দরবনের ১,৩৯,৭০০ হেক্টর বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য এলাকাকে ৭৯৮তম বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করেছে।  ১৯০৩ সালে মি. প্রেইন সুন্দরবনের গাছপালার উপর লিখিত তাঁর গ্রন্থে ৩৩৪টি উদ্ভিদ প্রজাতি লিপিবদ্ধ করেছেন। ১৬৫ প্রজাতির শৈবাল ও ১৩ প্রজাতির অর্কিডও পাওয়া যায় সুন্দরবনে। প্রায় ৫০টি প্রকৃত ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ প্রজাতির মধ্যে কেবল সুন্দরবনেই আছে ৩৫টি প্রজাতি। এ বনের প্রধান বৃক্ষ প্রজাতি সুন্দরী এবং গেওয়া। এছাড়া পশুর, ধুন্দল, গরান, বাইন, কাঁকড়া, কেওড়া ইত্যাদি গাছও প্রাকৃতিক ভাবে জন্মে। সুন্দরবন নানা ধরনের প্রাণীবৈচিত্র্যে অনন্য। রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ আবাসস্থল হলো সুন্দরবন। সুন্দরবনে প্রায় ২৮৯ প্রজাতির স্থলজ প্রাণী বাস করে। এছাড়া আছে প্রায় ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ, ৮ প্রজাতির উভচর এবং বিভিন্ন প্রজাতির মাছসহ ২১৯ প্রজাতির জলজ প্রাণী। রয়েল বেঙ্গল টাইগার ছাড়া সুন্দরবনের উল্লেখযোগ্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে রয়েছে চিত্রা হরিণ, মায়া হরিণ, রেসাস বানর, বন বিড়াল, সজারু, উদ বিড়াল এবং বন্য শূকর।  প্রায় ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপের মধ্যে সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় সদস্য মোহনার কুমির; এদের সংখ্যা মাত্র ২০০। সাপের মধ্যে রাজগোখরা, অজগর, কেউটে উল্লেখযোগ্য। অমেরুদন্ডী প্রাণীর মধ্যে কতিপয় মোলাস্কা এবং ক্রাসটেসিয়ান গুরুত্বপূর্ণ মৎস্যসম্পদ হিসেবে বিবেচিত। প্রজাতিগুলির মধ্যে তালিকাবদ্ধ হয়েছে প্রায় ২৪ প্রজাতির চিংড়ি, ১৪ প্রজাতির কাঁকড়া, কয়েক প্রজাতির শামুক এবং ঝিনুক। সুন্দরবনে বসবাসকারী অধিকাংশ পাখিই স্থানীয় বা আবাসিক। প্রায় ৫০ প্রজাতির পাখি পরিযায়ী এবং এদের অধিকাংশই হাঁসজাতীয়।  সুন্দরবনের কীটপতঙ্গের বৈচিত্র্যও সীমাহীন। সর্বশেষ জরিপ মোতাবেক সুন্দরবনে ১০৬ টি বাঘ ও ১,০০,০০০ থেকে ১,৫০,০০০ চিত্রা হরিণ ও ২০,০০০ বানর রয়েছে। গবেষণা মতে এই প্রানীবৈচিত্র্যের মধ্যে ২ প্রজাতির উভচর, ১৪ প্রজাতির সরীসৃপ, ২৫ প্রজাতির পাখি এবং ৫ প্রজাতির স্তনপায়ী বর্তমানে হুমকির মুখে। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য বন অধিদপ্তর তথা সরকার কর্তৃক নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। ১৯৯৬ সালে সুন্দরবনে তিনটি অভয়ারণ্য ও ২০১২ সালে তিনটি ডলফিন অভয়ারণ্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এবং ২০১৪ সালে সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড কে মেরিন প্রটেক্টেড এরিয়া হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।

 

বাংলাদেশে তথা সুন্দরবনে স্মার্ট টহলঃ 

 

সুন্দরবন ও এর জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণ গুরুত্ব বিবেচনা করে ইউএসএআইডি এর অর্থায়নপুষ্ট বাঘ প্রকল্পের সহযোগীতায় ২০১৫ সালের জুন মাস হতে সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের সাতক্ষীরা রেঞ্জের পশ্চিম বন্যপ্রাণী অভয়ারন্যে স্মার্ট টহল শুরু করা হয়। সারা বিশ্বে জলজ পরিবেশে বাংলাদেশের সুন্দরবনেই প্রথম স্মার্ট টহল শুরু হয়। পরবর্তীতে স্ট্রেনদেনিং রিজিওনাল কো-অপারেশান ফর ওয়াইল্ডলাইফ প্রোটেকশন প্রকল্পের অর্থায়নে ২০১৬ সালের জুন মাস হতে সুন্দরবনের অপর রেঞ্জসমূহে স্মার্ট টহল সম্প্রসারণ করা হয়। ২০১৬ সালের জুন হতে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ৩০ টি টহল পরিচালনা করা হয়। নদীপথে ৩১,৬৬৪ কিলোমিটার টহল করে অবৈধ অনুপ্রবেশ, অননুমোদিত জাল/অননুমোদিত ফাঁসের জাল ব্যবহার, অননুমোদিত সাইজের কাঁকড়া/মাছ ধরা, বন্যপ্রাণী শিকার এবং শিকার নিষিদ্ধ এলাকায় মাছ ধরার কারনে  মোট ১৭৭ জন আসামীকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৭০ টি ডিঙ্গি নৌকা, ৩১ টি ট্রলার, ১০৮ টি বিভিন্ন দৈর্ঘ্য ও ধরণের মাছ ধরার জাল ও অন্যান্য মালামাল জব্দ করা হয়। সনাতন বা প্রচলিত পদ্ধতিতে টহল পরিচালনা করে এমন সফলতা এবং প্রতিবেদন/তথ্য প্রাপ্তির আশা করা যায়না। ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেসন সোসাইটি ও জিআইজেড এর সহযোগীতায় সুন্দরবনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য সকল আইন/বিধি, বন্যপ্রাণী শনাক্তকরণ, আইন প্রয়োগ, স্মার্ট টহল পরিচালনা পদ্ধতি, জিপিএস ও সাইবার ট্র্যাকার এর ব্যবহার, বন্যপ্রাণী অপরাধ চিত্র ব্যবস্থাপনা, গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ পদ্ধতি, নিরাপত্তা প্রভৃতি বিষয়ে এ পর্যন্ত ২১৬ জন কর্মকর্তা/কর্মচারীকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। গত ২০১৫ সালের আগস্ট মাসের পর হতে সুন্দরবনে কোন বাঘ হত্যার ঘটনা ঘটেনি। সুন্দরবনের আশেপাশের জনসাধারণও স্মার্ট টহলের প্রসংশায় পঞ্চমুখ। অপরাধীরা বনের ভেতরে অবস্থান করতে না পারার কারনে বেশ কয়েকটি বন-দস্যু দল ইতোমধ্যে আত্মসমর্পণ করেছে। স্মার্ট টহল সকলের নিকট গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছে। ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেসন সোসাইটি ও জিআইজেড এর সহযোগীতায় স্মার্ট টহলের হ্যান্ডবুক তৈরি করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বে অগ্রগামী। অন্য কোন দেশে স্মার্ট টহলের হ্যান্ডবুক নেই। 

 

স্মার্ট টহলের পদ্ধতিঃ

 

প্রতি রেঞ্জে দুইটি নিয়মিত টহল দল গঠন করা হয়। প্রতি মাসে প্রত্যেক রেঞ্জে দুইটি টহল পরিচালনা করা হয়। টহল দল দুইটি পর্যায়ক্রমে টহল করে। প্রত্যেক টহল দল ১২-১৪ দিন এবং প্রতিদিন ৬-৮ ঘন্টা করে টহল করে। কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমোদিত টহল পরিকল্পনা অনুযায়ী সংরক্ষিত এলাকার প্রবেশযোগ্য সব স্থানে জলযানে ও পায়ে হেঁটে টহল করা হয়। প্রতিমাসেই প্রবেশযোগ্য স্থানসমূহের অন্ততপক্ষে ৭৫% এলাকা টহলের আওতায় আনা হয়। বাদ পড়া ২৫% এলাকা পরবর্তী মাসের টহলের আওতায় আনা হয়। মাসিক টহলের অন্তত ৫% পায়ে হেঁটে সম্পন্ন করতে হয়। অপরাধের হটস্পট অর্থাৎ যেখানে পূর্বে কোন টহল দল তিনের অধিকবার অবৈধ কার্যক্রম রেকর্ড করেছে এমন স্থান নিয়মিতভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়। পূর্ববর্তী টহলের ফলাফলের উপর ভিত্তি করে পরবর্তী টহল পরিকল্পনা তৈরি করা হয়। টহল দলের সাথে ‘স্মার্ট টহলের হ্যান্ডবুক’, টহলের লগ বই, মানচিত্র, জরুরী যোগাযোগ নম্বর, সাইবার ট্র্যাকার, জিপিএস, খাদ্য, মোবাইল ফোন, ভিএইচএফ রেডিও, ওয়াকি-টকি, ফার্স্ট এইড কিট এবং স্মার্ট টহলের হ্যান্ডবুকে উল্লিখিত অন্যান্য সরঞ্জাম রাখা হয়। প্রতিটি স্মার্ট টহল দলে ৮ জন সদস্য থাকে, তবে নৌকা/ট্রলারে করে টহল করলে এ সংখ্যা ৬ জনে কমিয়ে আনা হয়। প্রত্যেক টহল দলে (ক) দল নেতা, (খ) সহকারী দলনেতা (যোগাযোগ কর্মকর্তা), (গ) স্মার্ট ডাটা রেকর্ডার, (ঘ) বন্যপ্রাণী ও হুমকি পর্যবেক্ষণ কর্মকর্তা এবং (ঙ) অস্ত্রধারী নিরাপত্তা কর্মী (৪ জন) থাকেন। এছাড়া টহলের যানবাহন ভেদে প্রতিটি টহল দলের সাথে অন্যান্য জনবল থাকা বাঞ্ছনীয়। টহল দলের প্রত্যেক সদস্যের সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব রয়েছে, যা স্মার্ট হ্যান্ডবুকে উল্লেখ করা আছে। টহল দলের সকল সদস্যকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হয়। নিরাপত্তার বিষয় সর্বাধিক গুরুত্ব পায়। টহলের সময় সার্বক্ষণিকভাবে বন্যপ্রাণী পর্যবেক্ষণ এবং বন/বন্যপ্রাণী অপরাধ অনুসন্ধান করা হয়। টহল দলের সদস্যদের সাথে আবাসন লঞ্চ এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করা হয়। কোন বিপজ্জনক পরিস্থিতির উদ্ভব হলে অবিলম্বে সাহায্যের জন্য রেঞ্জ অফিসারের সাথে যোগাযোগ করতে হয়। স্মার্ট টহল দল গোয়েন্দা নিয়োগের মাধ্যমে গোপন তথ্য সংগ্রহ করে টহল পরিচালনা করে। টহলকালে অপরাধের প্রমান/আলামত সংগ্রহ, সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে তল্লাশি এবং মামলা দায়েরের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করা হয়। অপরাধের দৃশ্য পর্যবেক্ষণের সময় প্রমাণ/আলামতসমূহ সংরক্ষণ করা হয় এবং প্রমাণ/আলামতসমূহ বিনষ্ট না করে ছবি তোলা হয়। তল্লাশি, অপরাধী গ্রেপ্তার, মালামাল জব্দকরণ, মামলা দায়ের সহ সংশ্লিষ্ট পরবর্তী কার্যক্রমের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আইন/বিধির নির্দেশনা অনুসরণ করা হয়। এছাড়া একটি রিজার্ভ টহল দল সর্বদা রেঞ্জ সদরে অবস্থান করে। রিজার্ভ টহল দল জরুরী অবস্থায় বা কার্যকরভাবে টহল পরিচালনা ও আইন প্রয়োগের জন্য অতিরিক্ত জনবল প্রয়োজন হলে মূল স্মার্ট টহল দলকে সহযোগীতা করে। স্মার্ট টহলে জিপিএস বা সাইবার ট্র্যাকার সম্বলিত যন্ত্র ব্যবহার করে চলাচল ও ডাটা সংগ্রহ করা হয়। সকল স্মার্ট টহলে একই ধরনের লগ বই ও ডাটা মডেল ব্যবহার করা হয়। সকল কার্যক্রম স্মার্ট টহলের লগ বই/সাইবার ট্র্যাকারে রেকর্ড করা হয়। এনড্রয়েড মোবাইল ফোনে ইন্সটলকৃত সাইবার ট্র্যাকার অ্যাপ্লিকেশন ওপেন করে অ্যাপ্লিকেশনের ডাটা মডেলের নির্দেশনা অনুসরণ করে সহজেই আইন প্রয়োগ ও বন্যপ্রাণী পর্যবেক্ষণ সংশ্লিষ্ট সকল তথ্য সংশ্লিষ্ট মোবাইল ফোনে সংরক্ষণ করা যায়। প্রতিদিন টহল শেষে টহলের জিপিএস হতে জিপিএক্স ফোল্ডার বা সাইবার ট্র্যাকার হতে ট্র্যাকলগ কম্পিউটারের একটি নির্দিষ্ট ফোল্ডারে ডাউনলোড করা হয় এবং জিপিএস বা সাইবার ট্র্যাকার নাম্বার, দলের নাম ও তারিখ দিয়ে উক্ত ফোল্ডারটির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়। অতঃপর মোবাইল নেটওয়ার্কের আওতায় আসলে ডাটা/ট্র্যাকলগ ডাটা ব্যবস্থাপকের নিকট ই-মেইলের মাধ্যমে প্রেরণ করা হয়। অতঃপর ডাটা ব্যাবস্থাপক স্মার্ট ডাটা ব্যবস্থাপনা ও প্রতিবেদন তৈরির কাজ সম্পন্ন করেন। সর্বশেষ ভার্সনের স্মার্ট সফটওয়্যারে ডাটা এন্ট্রি ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়। সফটওয়্যারে শুধু নির্দেশনা প্রদান করে ছক, তালিকা ও নকশা ভিত্তিক ফলাফল জানা যায় এবং প্রতিবেদনে উপস্থাপন করা যায়। টহলকালে চলাচলের পথের মানচিত্র, জলযান ভিত্তিক/পায়ে হেঁটে অতিক্রান্ত দূরত্ব, টহল কাভারেজ, গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিগণের বিস্তারিত তথ্য, আটককৃত মালামালের বিস্তারিত তথ্য, মানুষের সাথে মুখোমুখি হওয়ার স্থানসমূহের মানচিত্র, অপরাধ উদঘাটন/মালামাল আটকের স্থানের মানচিত্র, অবৈধ কার্যক্রমের তথ্য, অপরাধের হটস্পটের মানচিত্র, বিভিন্ন শ্রেণী/বর্গ/গণ ভিত্তিক বন্যপ্রাণীর পর্যাপ্ততা সম্বলিত মানচিত্র, বন্যপ্রাণী হটস্পটের মানচিত্র ইত্যাদি সম্বলিত প্রস্তুতকৃত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ পরবর্তী টহল দলকে দিক-নির্দেশনা প্রদান করেন। স্মার্ট টহল দল মোবাইল নেটওয়ার্কের আওতায় থাকলে ‘স্মার্ট কানেক্ট’ এর মাধ্যমে সরাসরি স্মার্ট টহল কার্যক্রম মনিটরিং করা সম্ভব।

 

স্মার্ট টহলের ভবিষ্যৎঃ

 

সুন্দরবনে জলজ পরিবেশে স্মার্ট টহল পরিচালনা কিছুটা ব্যয়বহুল। জলযানের জ্বালানী খরচই ব্যয়ের সর্বোচ্চ খাত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। টহলের উপযোগীতার দিক বিবেচনা করে প্রস্তাবিত সুন্দরবন সুরক্ষা প্রকল্পে স্মার্ট টহল অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। স্মার্ট টহল বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত জনবলের অন্য অঞ্চলে বদলী, টহলের উপযোগী জলযানের অভাব ও অপ্রতুল রক্ষণাবেক্ষণ, প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদির অভাব ইত্যাদি যথাযথভাবে স্মার্ট টহল কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে অন্তরায় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। চিহ্নিত অন্তরায়সমূহ দূরীভূতকরণের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করলে স্মার্ট টহলের মাধ্যমে সুন্দরবনের বন্যপ্রাণী ও বনজ সম্পদ রক্ষা করা সম্ভবপর হবে।   

 

শেষ কথাঃ

 

সুন্দরবনের ন্যায় বাংলাদেশের অন্যান্য বনাঞ্চলেও স্মার্ট টহল শুরু করা এখন সময়ের দাবী মাত্র। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনবল তৈরীর জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করার এখনই উপযুক্ত সময়। পাহাড়ী বন ও সমতলের শাল বনে স্বল্প ব্যয়ে স্মার্ট টহল পরিচালনা করা সম্ভব। সুনির্দিষ্ট, অর্জনযোগ্য, বাস্তব ও সময়োপযোগী পরিকল্পনাপ্রসুত এবং পরিমাপযোগ্য স্মার্ট টহলের মাধ্যমে বাংলাদেশের বন, বন্যপ্রাণী এবং জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা ও সমৃদ্ধ হবে- এমনটাই আশা করা যুক্তিযুক্ত।

 

প্রমাণপঞ্জিঃ

 

১। সুন্দরবনের ইতিহাস; এ. এফ. এম. আব্দুল জলীল (১৯৬৯)

২। সুন্দরবনে স্মার্ট টহলের হ্যান্ডবুক; বন অধিদপ্তর, ডব্লিউসিএস ও জিআইজেড-এসএমপি (২০১৭)

৩। Bengal District Gazetteers, Khulna; L.S.S. O’ Malley I.C.S. (1908)

৪। Ecological and human use characteristics of Freshwater dependent cetacean habitat in the Eastern Sundarbans reserved forest of Bangladesh; Md. Zahangir Alom (2014)

৫। First Phase Tiger Status Report of Bangladesh Sundarban;     WMNCD, Khulna, Forest Department (2015)

৬। https://newsroom.wcs.org (retrieved on 04/05/2017)

৭। https://www.zsl.org (retrieved on 04/05/2017)

৮। http://smartconservationtools.org (retrieved on 04/05/2017)